টাটার ডিমনা লেক ও দলমা পাহাড়: এক স্মরণীয় ভ্রমণ অভিজ্ঞতা

Bangla Pulse
By -
0

 

টাটার ডিমনা লেক ও দলমা পাহাড়: এক স্মরণীয় ভ্রমণ অভিজ্ঞতা

ডিমনা লেক – পাহাড় ও নীল আকাশের মনোরম দৃশ্য

গত আগস্ট মাসে আমরা তিন বন্ধু মিলে বেরিয়ে পড়েছিলাম শিল্পনগরী টাটা দেখার উদ্দেশ্যে।

সেইমতো বাড়ি থেকে সন্ধ্যা ৭টার সময় আমরা রওনা দিই সম্বলেশ্বরী এক্সপ্রেস ধরার জন্য। ওই ট্রেনে আমাদের রিজার্ভেশন ছিল।

ট্রেন আসার কথা ছিল রাত সাড়ে ১১টায়, কিন্তু শেষ অব্দি তা প্রায় একটা নাগাদ এসে পৌঁছায়। যাই হোক, আমরা ট্রেনে উঠে বসলাম আর রওনা দিলাম টাটা স্টেশনের উদ্দেশ্যে।

টাটায় পৌঁছানো

ট্রেন দেরিতে পৌঁছালেও আমরা সকালবেলাতেই টাটায় পৌঁছে যাই। সেখানে নেমে প্রথমেই আমরা সকলে মিলে চা খেলাম। এরপর অটো ঠিক করার চেষ্টা করি।

সমস্যা হল—আমাদের কারও টাটার ট্যুরিস্ট স্পট সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা ছিল না। কেউ ২০০০ টাকা দাবি করছিল, আবার কেউ নানা জায়গা ঘোরানোর লোভ দেখাচ্ছিল। শেষে এক কাকা বললেন, মাত্র ৬০০ টাকাতেই তিনি আমাদের ডিমনা লেক ও দলমা পাহাড় দেখাতে নিয়ে যাবেন। আমরা রাজি হলাম।

ডিমনা লেক

ডিমনা লেকের অন্য দিকের দৃশ্য – পাহাড় ও নীলাভ জলের মিলন

প্রথমেই পৌঁছালাম ডিমনা লেক। সকাল সকাল এই লেকের স্নিগ্ধ নীলাভ জল আর চারপাশের পাহাড় আর সবুজ প্রকৃতি সত্যিই মনোমুগ্ধকর। আমরা কিছু ছবি তুললাম এবং প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্য উপভোগ করলাম।
বড় শালগাছ ও ঘন বনভূমির প্রাকৃতিক সৌন্দর্য

এরপর অটোয় উঠে চললাম দলমা পাহাড়ের উদ্দেশ্যে।

দলমা পাহাড় ট্রেকিং

পাহাড়ের পাদদেশে সেতু ও বয়ে যাওয়া খাল

এখানেই ঘটল ছোট্ট ট্রাজেডি। অটো-ড্রাইভার কাকা আমাদের পাহাড়ের পাদদেশে নামিয়ে দিয়ে বললেন এখান থেকেই সহজে ওঠা যায়, তিনি আর অপেক্ষা করবেন না। তাই আমাদের ভাড়া মিটিয়েই আমরা শুরু করলাম পাহাড় চড়ার যাত্রা।
পাহাড়ঘেরা বনভূমির ভেতর দিয়ে চলা রাস্তা

শুরুতে উৎসাহ নিয়ে উঠতে থাকলেও, ধীরে ধীরে বুঝতে পারলাম—এটা ভীষণ খাড়া আর প্রায় ৬ কিমি পথ। যেখানে স্থানীয়রা ১.৫ ঘণ্টায় উঠে যায়, আমাদের লেগে গেল প্রায় সাড়ে ৪ ঘণ্টা!

বর্ষাকাল হওয়ায় পাহাড় সবুজে মোড়া ছিল। বৃষ্টির জল বয়ে যাওয়ার রাস্তা দিয়েই আমাদের ট্রেকিং করতে হচ্ছিল। কোনো দোকান, জল পানি বলতে কিছুই নেই—তাই আমরা কেবল নিজেদের ভরসাতেই চলছিলাম।

হনুমান পয়েন্ট ও গণেশ পয়েন্ট

প্রথমে পৌঁছালাম হনুমান পয়েন্টে। খানিক বিশ্রাম নিয়ে আবার হাঁটতে শুরু করলাম। এরপর এল গণেশ পয়েন্ট, যা প্রায় অর্ধেক পথ।

ও বলা হয়নি, এই অব্দি মানে এই গণেশ পয়েন্ট অবধি আমাদের এই যাত্রার সাথী হয়েছিল এক কুকুর। আমাদের সঙ্গে যারা পিছিয়ে পড়ছিল, তাদের পিছনেই বসে অপেক্ষা করত। কিন্তু এই গণেশ পয়েন্টে এসে ওকে আর দেখা যায়নি।

ওখানে একটি ছোট ঝর্ণা ছিল। প্রচণ্ড ক্লান্তির পর এই ঝরনা দেখে আমরা আর নিজেদেরকে আটকাতে পারিনি—ব্যাগ রেখে সোজা ঝরনায় নেমে স্নান করে নিলাম। ঠাণ্ডা জলে ক্লান্তি একেবারে উড়ে গেল।

দলমা বাবা মন্দির

এভাবে কষ্টকর ট্রেকিং শেষে অবশেষে পৌঁছালাম গাড়ি চলাচলের রাস্তায় যেটা টাটা স্টেশন থেকে প্রায় তিরিশ কিলোমিটার এর মতো ঘুরে এসেছে। সেখানে কাছেই ছিল দলমা বাবা মন্দির।

দলমা মাতা গুহা মন্দিরের ভেতরে রঙ মাখা প্রাকৃতিক শিলাখণ্ডে বেলপাতা, ধূপকাঠি ও প্রসাদ নিবেদন—অভ্যন্তরের কাঁচা দেওয়াল ও আলোছায়া।

প্রথমে দর্শন করলাম “দলমা মাতা”-কে, তারপর সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে গুহার মধ্যে দলমা বাবা দর্শন করলাম।

দলমা বাবা গুহা মন্দিরে শিবলিঙ্গের উপর বেলপাতা, পাশে ত্রিশূল ও ক্ষুদ্র মূর্তি, ভক্তদের ফুলপাতায় ভরা ভেজা মেঝে—শান্ত, অন্ধকার পরিবেশ।

সেখানে পুরোহিত কেউ ছিলেন না। আমরা ভক্তিভরে প্রণাম করে বেলপাতা ও নারকেল প্রসাদ নিলাম। এই তো দলমা বাবার মন্দিরের কাছে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ছিল মনোমুগ্ধকর।

দলমা পাহাড়ের ভিউপয়েন্ট থেকে বর্ষায় সবুজে ঢাকা ঝোপঝাড়, ঘাসজমি ও দূরের কুয়াশাচ্ছন্ন টিলার সারি—জঙ্গলময় প্রাকৃতিক ল্যান্ডস্কেপ।

মন্দির চত্বরে একটু বিশ্রাম নিয়ে আর এখানে একটা দোকানে ঘুগনি মুড়ি আর চপ খেয়ে নেমে আসার প্রস্তুতি নিলাম।

নামার পথ ও ঘাটশিলা যাত্রা

উপরে ওঠার মতোই নামার পথও সহজ ছিল না। হাঁটুর ওপর প্রচুর চাপ পড়ছিল। প্রায় দেড় ঘণ্টায় আমরা নিচে নেমে আসি। পথে আবার এক ঝরনায় নেমে স্নান করি, ক্লান্তি কিছুটা দূর হয়।

তারপর রাস্তার ধারে এসে অটো ধরে রওনা দিলাম ঘাটশিলা-র উদ্দেশ্যে। বাসস্ট্যান্ডে গিয়ে ভুট্টা খেয়ে, সেখান থেকে বাসে চেপে ঘাটশিলায় পৌঁছালাম।

ঘাটশিলার এক হোটেলে রাত কাটিয়ে পরের দিন আমরা ঘাটশিলা ভ্রমণে বেরোনোর পরিকল্পনা করলাম।

শেষকথা

এই ছিল আমাদের টাটা-ভ্রমণের এক ছোটো স্মৃতি — যেখানে খাড়া ট্রেক, ঝরনা, স্থানীয় অতিথি-সেবা আর মন্দির দর্শন মিলেছিল একসাথে।

পরামর্শ: আপনারা যদি টাটা-ভ্রমণের পরিকল্পনা করেন, হালকা জুতো, পর্যাপ্ত জল এবং ছাতা/রেইনকোট সঙ্গে রাখবেন — বিশেষত বর্ষাকালে।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন (0)

#buttons=(Ok, Go it!) #days=(20)

Our website uses cookies to enhance your experience. Check Now
Ok, Go it!