শ্যামলী মাসি: পাগলী নয়, এক মমতার নাম

Bangla Pulse
By -
0

 

শ্যামলী মাসি: পাগলী নয়, এক মমতার নাম

শ্যামলী মাসি – এক গ্রামীণ নারী, যিনি মমতার প্রতীক

এখন ভোর পাঁচটা। কনকনে শীত সেভাবে নেই বললেই চলে। গত কয়েক বছরে গরম বেড়েছে অনেকটাই। বাইরে প্রচণ্ড কুয়াশা। মাঝে মাঝে কুণ্ডলী পাকিয়ে ধোঁয়া এসে চোখ মুখ ঢেকে দিচ্ছে। এই ধোঁয়াশার মধ্যে কেন জানি না আজকে শ্যামলী মাসির কথা খুব মনে পড়ছে।

বয়স কত আর, মেরেকেটে চল্লিশ হবে। গায়ের রং কালো। কালো নয় ঠিক, শ্যামবর্ণ। তার যে কোথায় বাড়ি এ তল্লাটে কেউ জানে না। আমি যেখানে থাকি তার একপাশে হরিজন পল্লী, অন্যপাশে শাবরিয়া (শবর) পাড়া। একখানা বড় গাড়ি যদি কখনো এসে দাঁড়ায় দেখা যায় জনা কুড়ি মানুষের কৌতূহল ভিড় করে আছে। এমন পরিবেশে পাগলদের কেউ সেভাবে চোখে দেখে না। উল্টে তাকে নিয়ে ব্যাঙ্গ করার লোকের অভাব হয় না।

সালটা ২০০৯, নভেম্বর মাস। সদ্য ডাক্তারি শিখে আমি তখন নতুন চেম্বার করেছি গ্রামে। পাশফাস নয়, অন্য একজন ডাক্তারের কাছে থেকে আর কি! হাতুড়ে ডাক্তার হিসেবে খুব একটা পরিচয় নেই। সারাদিন একা চেম্বারে বসে বসে বাড়ি ফিরে আসি। প্রথম ছয় মাস কি একবছর হবে নিজের হাত খরচ চালাতে হিমসিম খেতে হচ্ছে। দু' একজন মাঝে মাঝে এসে প্রেসার চেকআপ করে পাঁচ টাকা হাতে গুঁজে দিয়ে চলে যায়। যেভাবে মাকে প্রণামী দেয় ভক্তগণ। ইনকাম বলতে সেটুকুই।

মানুষের বিশ্বাস অর্জন করা যে কতটা কঠিন হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছি। অল্প বয়সী ছেলে গ্রামীণ ডাক্তার, কে বিশ্বাস করে দেখাবে তার পরিবারকে!

একদিন দুপুর বেলা অঝোরে বৃষ্টি হচ্ছে... একা একা ঘরের দরজা জানালা বন্ধ করে দিয়ে একটা পাথরের মূর্তির দিকে তাকিয়ে কাঁদতে কাঁদতে ভাবছি কেন যে এই জীবিকাকে বেছে নিলাম আমি! আমার চেয়ে অনেক কমবয়সী ছেলেরা চেন্নাই-ব্যাঙ্গালোর গিয়ে ভালো ইনকাম করছে। কেন যে চেন্নাইয়ে ব্লক বওয়া বালি সিমেন্ট বওয়া বাদ দিয়ে এই পথে এলাম! একটু কষ্ট হতো না হয় তবুওতো দিনশেষে টাকার মুখ দেখে মিষ্টি হাসি হেসে ফেলতাম।

এসব ভাবতে ভাবতে বৃষ্টি কখন থেমে গেছে টের পাইনি। বিকেলে আবার সেই পুরনো সাইকেল নিয়ে অভ্যাসবসত চেম্বার। মাসে চারশো টাকা ঘরভাড়া। খালপাড়ের উপর বাঁশের খুঁটি পুঁতে তার উপর তক্তা ও টিন দিয়ে ঘেরা আমার ভবিষ্যৎ। জীবনে এমন একটি পেশা বেছে নিয়েছি যেখানে মানুষের অসুখের উপর আমার রোজগার। এসব ভাবলে নিজেকে খুব খারাপ লাগে।

প্লাস্টিকের একটা চেয়ারে বসে থাকি সারাদিন রাস্তার দিকে চেয়ে। কেউ একজন আসবে এই ভেবে।

এমন সময় শ্যামলী মাসির দেখা। পঞ্চাশের কাছাকাছি একজন মহিলা এসে খাওয়ার জন্য টাকা চাইছে। চারপাশের পরিবেশ তখন থমথমে। আমি বললাম মাসি আমার কাছে কোনো টাকা নেই। "আচ্ছা বাবা ঠিক আছে"— বলে চলে গেলেন। সেদিন নিজেকে কতটা অসহায় লেগেছিল বলে বোঝাতে পারবো না।

দিন তিনেক পরে আবার একদিন সকালে এসে একই কথা, "বাবা খুব খিদে পেয়েছে কিছু টাকা দাও না।" আমি তখন মাসে হয়তো দু'পাঁচদিন সকালে টিফিন করতাম। এমনিতেই কাছে টাকা থাকত না। তার উপরে এতবড় ছেলে বাড়িতেও টাকা চাইতে পারতাম না।

তবে সেদিন কাছে দশ টাকা ছিল। বললাম মাসি দেওয়ার মতো টাকা আমার কাছে নেই। তবে তোমাকে খাওয়াতে পারি। তুমি এখানে একটু সময় বসো, আমি মুড়ি আনছি। এই বলে চটপট সাইকেল নিয়ে মুড়ি একশো গ্রাম সঙ্গে একটা গরম চপ এনে দিলাম।

                                  বৃষ্টিভেজা বিকেলে প্রথম দেখা – ক্ষুধার্ত শ্যামলী মাসি মুড়ি-চপ খাচ্ছেন

শ্যামলী মাসি খেতে লাগলো। অর্ধেক খাওয়ার পরে জিজ্ঞেস করলাম—

"মাসি তোমার বাড়ি কোথায়?"
কোনো উত্তর না দিয়ে আবার খেতে লাগলো। ভাবলাম খিদে পেয়েছে খুব। এই খিদের সময় এসব না জিজ্ঞেস করলেই ভালো হতো বোধহয়।

খাওয়া শেষে আবার সেই একই প্রশ্ন জিজ্ঞেস করতে বললেন—
"প্রজাপাড়ের খেয়ার কাছে।"

— "তোমার ছেলে মেয়ে কেউ নেই?"
"আছে তো বাবা। চার ছেলে বউমা, নাতিপুতি সবাই আছে।"
— "তাহলে তুমি এরকম খাওয়ার চেয়ে বেড়াচ্ছ, তোমাকে কি ছেলে বউরা খেতে দেয়নি কেউ?"

আর একটিও কথা না বলে শুধু চোখ দিয়ে জল ফেলে গেল।

এরপর যতগুলো কথা জিজ্ঞেস করেছি উত্তর পাইনি। শুধু কেঁদেই গেল।

বেশকিছু দিন পরে আমাদের গ্রামে এক শবর পরিবারে এসে থাকতে শুরু করল মাসী। তাদের বাড়ির কাজকর্ম করত। সময় পেলে এখানে ওখানে ভিক্ষা করতে বেরিয়ে পড়ত। আর আমার সঙ্গে দেখা হলে হাতের আঙুলগুলো দিয়ে আমার গাল ছুঁয়ে চুমু খেতে খেতে তাঁর স্নেহের হাত মাথায় বুলিয়ে দিত।

পরে একদিন সেই বাড়িতে তাঁর অজান্তে গিয়ে জানতে পারি মহিলাটির মাথার সমস্যা আছে। কালো রঙের বলে ওই বাড়ির লোকই তাকে শ্যামলী নাম দিয়েছে। এভাবে বেশকিছু দিন ওই বাড়িতেই ছিল। মাঝে কোথায় যে চলে গেল কেউ জানে না!

একদিন দুপুর বেলা সাইকেল নিয়ে আমি বাড়ি ফিরছি। প্রচণ্ড গরম। বাইরে তখন খাঁ খাঁ রোদ। দেখি সেই মিষ্টি হাসি নিয়ে শ্যামলী মাসি। আমি দাঁড়ালাম। সে আমার কপালে চুমু খেয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলল—
"বাবা একটা দিন একটু মাংস ভাত খাবা না, কতদিন মাংস খাইনি।"

আমি তাঁর মুখের দিকে তাকিয়ে অসহায় ভাবে সেদিন বলেই ফেললাম জীবনের চরমতম সত্যি কথাগুলো। তার হাত দুহাতে জড়িয়ে ধরে বললাম—
"মাসি, আমি এখন নতুন চেম্বার করেছি। নিজের খরচ নিজে চালাতে পারি না। সারামাসে মেরেকেটে সাত আটশ রোজগার। তার মধ্যে ঘরভাড়া চারশো টাকা দিতে হয়। মাংস ভাত তো অনেকদূর, আমি নিজেও কোনদিন সকালে খাই না। দুপুরে একবারে পেটভরে ভাত খাই। যেদিন আমি ভালো টাকা আয় করতে পারব সেদিন তোমাকে পেট ভরে মাংস ভাত খাওয়াব।"

                               চোখের জলে ভিজে থাকা শ্যামলী মাসির মুখ

এই কথা শুনে তার চোখ বেয়ে অঝোরে জল গড়িয়ে পড়ল। আমার মাথায় তার সেই স্নেহের হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলল—

"সব ঠিক হয়ে যাবে বাবা।"

এই কথা বলে চলে গেল। আমি খানিকটা থ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। চোখ বন্ধ করে ভাবলাম কে বলে মাসির মাথার সমস্যা আছে। ওই তো সবকিছুই অন্তর থেকে উপলব্ধি করতে পারছে। তাহলে যে সবাই পাগলী ভেবে এতো ব্যাঙ্গ করে কিসের তরে! আমি শুধু এসব কথা ভাবতেই পেরেছিলাম কিন্তু কোনদিন এই নিয়ে কারোর মুখের উপরে কিছু বলতে পারিনি।

তারপর থেকে প্রায়শই দেখা হলেও কোনদিন আর খাওয়ারের কথা বলত না তিনি। উল্টে তাঁর সেই মিষ্টি হাসি দিয়ে আমার মাথায় স্নেহের হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলত—
"একদিন সব ঠিক হয়ে যাবে বাবা।"

এরপর বছরখানেক পরে একদিন আমি ভীষন অসুস্থ হয়ে পড়ি। তমলুকে ঔষধ খেয়ে খুব একটা সুবিধা হচ্ছে না দেখে ভেলোরে যাওয়ার চিন্তা করি। যেহেতু আমার কাছে অত টাকা নেই, তাই বেশ কয়েকজনকে সঙ্গে নিয়ে গেলাম। যেহেতু আমার একজন পরিচিত মানুষের মাধ্যমে ওখানের রাস্তা ঘাট, ভাষা তখন আমি অনেকটাই রপ্ত করে নিয়েছি।

এভাবে বেশ কয়েকবছর গ্রামে পেশেন্ট দেখা আর ভেলোরে যাতায়াত চলতে থাকে। এর মাঝে পেরিয়ে গেছে প্রায় দশ বারো বছর। শ্যামলী মাসিকে আর এ গাঁয়ে দেখতে পাওয়া যায়নি। এর তার কাছে ঠিকানা নিয়ে আমি অনেক খুঁজেছি তাঁকে। সবকটি ভুল ঠিকানা। কেউ সঠিক করে বলতে পারছে না কোথায় গেছে। সময়ের সাথে সাথে মাসীও হয়তো নিজেকে পাল্টে নিয়েছে!

এমন মিথ্যা সান্ত্বনা দিয়ে প্রতিনিয়ত এগিয়ে যাই পরের গন্তব্যে।

এখন আমার অনেক বন্ধু। ফিস্টি হলে প্রায়শই মাংস ভাত হয়। শুধু প্রতিবার খাওয়ার আগে শ্যামলী মাসির মুখটা মাংসের থালার উপর ভেসে উঠে। দুধসাদা ভাতের উপর যখন মাংসের ঝোল পড়ে কে যেন আমার মাথায় তার স্নেহের হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলে—

                                       মাংস ভাতের থালার উপরে শ্যামলী মাসির আশীর্বাদ


"বাবা, একটা দিন মাংস ভাত খাবা না, অনেকদিন মাংস ভাত খাইনি।"





✍ সুব্রত মন্ডল

এই লেখাটি লিখেছেন সুব্রত মন্ডল, উনি একজন লেখক ও কবি এবং সেই সাথে উনি একজন গ্রামীণ চিকিৎসক। সমাজ, মানুষ আর জীবনের অভিজ্ঞতা তাঁর লেখায় প্রতিফলিত হয়।

All images in this article are AI-generated visuals.

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন (0)

#buttons=(Ok, Go it!) #days=(20)

Our website uses cookies to enhance your experience. Check Now
Ok, Go it!