Sikkim Travel: গ্যাংটক থেকে লাচুং ও জিরো পয়েন্ট — এক অবিস্মরণীয় অভিজ্ঞতা

Bangla Pulse
By -
0

 

গ্যাংটক থেকে লাচুং ও জিরো পয়েন্ট

পর্বত উপত্যকার সবুজ মাঠে ঘাস খাচ্ছে একটি ইয়াক ও শান্ত প্রাকৃতিক পরিবেশ

শহরের কোলাহল থেকে মুক্তি পেতে পাহাড় সবসময়েই আমাদের টানে। এবারের গন্তব্য ছিল ভারতের অন্যতম সুন্দর রাজ্য সিকিম—যেখানে বরফ, সবুজ বন, ঝরনা আর পাহাড়ি সৌন্দর্য মিলেমিশে এক অনন্য রূপ ধারণ করেছে। আমরা তিন বন্ধু হলদিয়া থেকে এই ভ্রমণে রওনা দিয়েছিলাম। শনিবার সন্ধ্যা সাতটায় তমলুক থেকে পাহাড়িয়া এক্সপ্রেস ধরে যাত্রা শুরু, আর পরের দিন সকালেই পৌঁছালাম নিউ জলপাইগুড়ি (NJP)। সেখান থেকে অটো করে শিলিগুড়ি, তারপর SNT বাস স্ট্যান্ড থেকে শেয়ার গাড়ি (বোলেরো টাইপ) ধরে দুপুর নাগাদ পৌঁছে গেলাম গ্যাংটকে।

🏙️ প্রথম দিন: গ্যাংটকের আড্ডা ও এমজি মার্গের সন্ধ্যা

এমজি মার্গ, গ্যাংটকে গান্ধী মূর্তির সামনে তিন বন্ধু

হোটেলে ঢুকে লাঞ্চ সেরে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিলাম। বিকেলে শুরু হল আমাদের গ্যাংটক দর্শন—প্রথমেই রোপওয়ে চড়ার এক দারুণ অভিজ্ঞতা। উপরে উঠে চোখের সামনে মেঘে ঢাকা পাহাড়ি শহরের ছবি যেন রূপকথার মতো। সন্ধ্যায় পৌঁছে গেলাম MG Marg-এ, গ্যাংটকের প্রাণকেন্দ্র। রঙিন আলো, দোকানপাট, পর্যটকের ভিড়—সব মিলিয়ে এক উৎসবমুখর পরিবেশ। রাতের ডিনারে স্থানীয় মোমো আর শিক কাবাব খেয়ে দিন শেষ করলাম।

🗺️ দ্বিতীয় দিন: নাথুলা পাস না, লোকাল সাইটসিন

তুষার ঢাকা পর্বতের মাঝে ট্রেকিং পথ ও বরফে মোড়া প্রকৃতি

আমাদের পরিকল্পনা ছিল নাথুলা পাস যাওয়ার, কিন্তু সোমবারে সেখানে অনুমতি দেওয়া হয় না। তাই দিনটা কাটালাম গ্যাংটকের আশেপাশের দর্শনীয় স্থানগুলো ঘুরে। প্রথমে তাশি ভিউ পয়েন্ট, যেখান থেকে হিমালয়ের তুষারঢাকা চূড়ার মনোমুগ্ধকর দৃশ্য দেখা যায়। এরপর গণেশ টক আর হনুমান টক, যেখানে পাহাড়ের চূড়ায় মন্দির আর চারপাশে মনোরম প্রাকৃতিক সৌন্দর্য। আমরা ঘুরে এলাম ইচি মনাস্ট্রি থেকেও, যেখানে শান্ত পরিবেশে দাঁড়িয়ে যেন সময় থমকে যায়। বিকেলে আবার এমজি মার্গে আড্ডা আর কেনাকাটা, তারপর রাতের ডিনার সেরে ঘুম।

🚗 তৃতীয় দিন: নর্থ সিকিমের পথে

পরের দিন সকালে হোটেল ম্যানেজারের সাহায্যে আমরা নর্থ সিকিম ভ্রমণের পাসের ব্যবস্থা করলাম। এখানে শুধু EPIC কার্ড দিয়েই অনুমতি মেলে, আর আমাদের ছবি তুলে জমা দেওয়া হল। সব ঠিকঠাক করে রাতে ঘুমোনোর প্রস্তুতি নিলাম। বুধবার সকালে আমরা বাজরা ট্যাক্সি স্ট্যান্ড থেকে শেয়ার গাড়িতে উঠলাম, মোট ৯ জন যাত্রী। সকাল ১১টায় গাড়ি ছাড়ল। আমাদের ড্রাইভার শুরুতেই সাবধান করলেন, সামনে কঠিন রাস্তা, যেকোনো অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতির জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুত থাকতে হবে। পথে প্রথমেই দেখা পেলাম সেভেন সিস্টার ওয়াটারফলস—দূর পাহাড় থেকে সাতটি ধারা ঝরে পড়ছে নিচে, যেন প্রকৃতির বুকে এক অপূর্ব সঙ্গীত। এরপর লাঞ্চের জন্য থামলাম মঙ্গনে। তারপর গাড়ি চলতে লাগল তিস্তা নদীর পাশ দিয়ে। চেকপোস্টে আমাদের পাস চেক করা হল, তারপর শুরু হল পাহাড়ি আঁকাবাঁকা রাস্তা—৪৩টি U turn বাঁক পেরোতে গিয়ে মনে হচ্ছিল যেন কোনো এক জীবন্ত অভিযানে নেমেছি। সন্ধ্যা সাতটার দিকে পৌঁছালাম আর্মি চেকপোস্টে, যেখানে নিয়মমতো সব প্লাস্টিক ফেলে দিতে হল। আলো কমে আসায় আমরা অমিতাভ বচ্চন ওয়াটারফলস ঠিকভাবে দেখতে পারিনি। অবশেষে রাত আটটার দিকে পৌঁছালাম লাচুং-এ। চারপাশে বরফঢাকা পাহাড়, শীতল হাওয়া আর মনোরম দৃশ্য। তবে বিদ্যুৎ চলে গিয়েছিল, আর তাপমাত্রা নেমে গিয়েছিল ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াসে। ড্রাইভার দ্রুত ডিনার সেরে ঘুমোতে বললেন, কারণ ভোরে আমাদের বেরোতে হবে।

❄️ চতুর্থ দিন: কাটাও, ইয়ুমথাং ভ্যালি আর জিরো পয়েন্ট

একটি ইয়াক পর্বত উপত্যকার সবুজ মাঠে ঘাস খাচ্ছে

ভোরে আমরা বেরিয়ে পড়লাম জিরো পয়েন্ট আর কাটাও এর উদ্দেশ্যে। ড্রাইভারকে অতিরিক্ত টাকা দিতে হল এই জিরো পয়েন্ট আর কাটাও যাওয়ার জন্য, তবে সেই অভিজ্ঞতা ছিল অমূল্য। প্রথমে কাটাও—পাহাড়ের ঢালে জমে থাকা তুষার, খাড়া ঝরনা আর দূর থেকে দেখা লাচুং শহর, যেন ছবি আঁকা দৃশ্য। পথে রাস্তার ধারে শান্তভাবে দাঁড়িয়ে ছিল 'ইয়াক' বা 'চামরি গাই'। আমরা একটির কাছে গিয়ে ছবি তুলতে চাইতেই সে হঠাৎ দৌড়ে পালাল, মুহূর্তটা বেশ মজার ছিল। এরপর পৌঁছালাম ইয়ুমথাং ভ্যালি। পাহাড় থেকে নদীর ধারে নেমে আসা পাইন বন, চারপাশে গাছপালা আর রঙিন ফুল—বেগুনি, লাল, গোলাপি, হলুদ রডোডেনড্রন। দৃশ্যটা এতটাই সুন্দর যে মনে হচ্ছিল, পৃথিবীর বাকি সব ভুলে শুধু আমাদের ভারতকেই ভালোবাসি। লাচুং নদীর তীরে দাঁড়িয়ে প্রকৃতির অপরূপ রূপ উপভোগ করছিলাম। দূরে দেখা যাচ্ছিল এক হটস্প্রিং, ওঠার কাছে যাওয়া আমাদের পক্ষে সম্ভব হয়নি। সবশেষে আমরা পৌঁছালাম জিরো পয়েন্টে—উচ্চতা প্রায় ৪,২৫৭ মিটার। চারপাশে শুধু বরফ আর বরফ। প্রচণ্ড ঠান্ডায় শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছিল, কর্পূর ব্যবহার করতে হচ্ছিল। তবুও সেই দৃশ্য চোখে পড়ার মতো—যেন সাদা রঙের এক অদ্ভুত স্বর্গরাজ্য।

🏠 ফিরে আসা

দুপুরে লাচুং ফিরে লাঞ্চ সেরে আবার গ্যাংটক রওনা
হলাম। রাতে দেউরালি বাসস্ট্যান্ডের কাছে এক হোটেলে উঠলাম। ডিনার সেরে শরীরের ক্লান্তি দূর করতে শুয়ে পড়লাম। পরের দিন সকালে বাস ধরে শিলিগুড়ি, তারপর তিস্তা তোর্সা এক্সপ্রেসে চেপে বাড়ি ফেরা।

🌟 সবশেষে,

এই ভ্রমণ আমাদের জীবনের অন্যতম সেরা অভিজ্ঞতা। গ্যাংটকের রঙিন এমজি মার্গ, রোপওয়ের দারুণ দৃশ্য, নর্থ সিকিমের আঁকাবাঁকা রাস্তা, লাচুংয়ের শীতল হাওয়া, ইয়ুমথাং ভ্যালির ফুলে ভরা স্বর্গরাজ্য আর জিরো পয়েন্টের তুষার—সব মিলিয়ে সিকিম এক অবিস্মরণীয় স্মৃতি হয়ে থাকবে। ভ্রমণ শেষে মনে হল, প্রকৃতির সৌন্দর্য উপভোগ করতে চাইলে ভারতের পাহাড়গুলোই যথেষ্ট।





✍ সুজিত কুমার মাইতি 

এই লেখাটি লিখেছেন সুজিত কুমার মাইতি ,উনি একজন ভ্রমণ পিপাসু মানুষ, এই লেখার মাধ্যমে উনি ওনার সিকিম ভ্রমণের অভিজ্ঞতাকে সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন (0)

#buttons=(Ok, Go it!) #days=(20)

Our website uses cookies to enhance your experience. Check Now
Ok, Go it!